আবদুল্লাহ হিল রাকিব
সম্প্রতি একটি ইংরেজী পত্রিকা ও ক্রিশ্চিয়ান এইড আয়োজিত এক ওয়েবিনারের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর ভালো উদ্যোগ।’ ওয়েবিনারটিতে অংশগ্রহণ না করলে আলোচকদের অনেকেই হয়তো জানতেই পারতেন না যে আমাদের পোশাক কারখানাগুলোতে এতসব ভালো উদ্যোগ রয়েছে। দেশি ও বিদেশি আলোচকদের সকলেই যা জেনে অভিভূত হয়েছেন।
দুঃখজনক বিষয় হলো বাংলাদেশের পোশাকশিল্প এখনো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রানা প্লাজা দুর্ঘটনা দ্বারা বিবেচিত হয়। যদিও রানা প্লাজা পরবর্তী বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ও এই দুর্ঘটনা পূর্ববর্তী শিল্পের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ; আমাদের শিল্পের ভালো গল্প গুলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এখনো আসে না।
বরং প্রায়ই আমরা দেখতে পাই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আমাদের শিল্পের একটি রুগ্ন প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হচ্ছে, যা মোটেই বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বর্তমান অবস্থা নয়।
সম্প্রতি হংকংয়ে অবস্থিত কমপ্লায়েন্স কোম্পানি কিউমার জরিপে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প ‘নৈতিক প্রস্তুতকরণে’ বিশ্বের দ্বিতীয় বলে আখ্যায়িত হয়েছে। আমাদের উপরে আছে কেবল তাইওয়ান। এ জরিপে কারখানাগুলোর নিরাপত্তা, শিশুশ্রম, শ্রমিক স্বাস্থ্য ও অধিকার, মজুরি শ্রমঘণ্টা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি আমলে আনা হয়েছে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প একদিকে যেমন নিরাপত্তা নিশ্চিতে বৈশ্বিক মান অর্জন করেছে, তেমনি টেকসই উন্নয়নে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। আমাদের দেশে বর্তমানে ১৪৪ টি সবুজ পোশাক কারখানা রয়েছে যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। শুধু তাই নয়, দেশের প্রায় আরো ৫০০ টি পোশাক কারখানা সবুজের জন্য ইউনাইটেড স্টেট গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিলে নিজেদের নিবন্ধিত করেছে।
আমাদের পোশাক শিল্পের এ সকল ইতিবাচক দিকগুলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসে না। যার ফলে পাশ্চাত্য বিশ্বে আমাদের পোশাকের ক্রেতাগণ জানতে পারেন না আমাদের এসব গল্পগুলো।
অনেক সময় আমরা দেখি, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা করছে যা সত্য নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নিউইয়র্ক টাইমস সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত সজীব গ্রুপ এর অগ্নিকাণ্ডকে পোশাক শিল্পের সঙ্গে মিলিয়ে রিপোর্ট করেছে। অথচ সজীব গ্রুপ কোন পোশাক কারখানা নয়। এ ধরনের রিপোর্টকে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা বললে কি ভুল হবে?
প্রাশ্চাত্য দেশের ক্রেতাগণ এ ধরনের রিপোর্ট দ্বারা বিভ্রান্ত হন। যেমন নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টটির নিচে তাদের অনেকে মতামত দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন “এখনই সময় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ পোশাক বয়কট করার। কোন কিছুই সেখানে পরিবর্তিত হয়নি। সুতরাং এই বয়কট-ই একমাত্র ক্ষমতা যা আমাদের রয়েছে।” একটি ভুল রিপোর্ট এভাবে আমাদের অর্জনগুলোকে ধুলিস্যাৎ করে দিতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো-আমাদের কি এক্ষেত্রে কিছু করণীয় রয়েছে? আমি মনে করি অবশ্যই রয়েছে। ডিজিটাল এ যুগে বিশ্বের যেকোন প্রান্তে প্রকাশিত রিপোর্ট পৌঁছে যায় পাঠকের কাছে। সুতরাং আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলো যদি বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ইতিবাচক গল্পগুলো তুলে ধরতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তাহলে প্রাশ্চাত্য দেশের অনেক পাঠকগণই তা জানতে পারবেন। এইসব ইতিবাচক গল্প যখন আমাদের গণমাধ্যমে বেশি বেশি প্রকাশিত ও প্রচারিত হতে থাকবে, তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোরও টনক নড়তে বাধ্য। তারাও হয়তো তখন অনুপ্রাণিত হবেন ভুল রিপোর্ট থেকে সরে আসতে অথবা ইতিবাচক রিপোর্ট তৈরি করতে।
আমি অবশ্যই বলছি না যে আমাদের গণমাধ্যম পোশাক শিল্পের ভুল ত্রুটি নিয়ে রিপোর্ট করবেন না। বরং আমাদের গণমাধ্যমের গঠনমূলক রিপোর্ট সবসময় আমাদের শিল্পের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। আমি বলছি- যে শিল্প হতে দেশের প্রায় ৮৪ শতাংশ রপ্তানি আয় অর্জিত হয়, যে শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক ভাই-বোনেরা কাজ করেন, সেটি ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে আমাদের সকলেরই দায় রয়েছে।
‘মেড ইন বাংলাদেশ’ কে আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে একটি গৌরবের ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করাতে আমাদের সবার একসাথে কাজ করার এখনই উপযুক্ত সময়।
আবদুল্লাহ হিল রাকিব টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-এর একজন পরিচালক।